হুমায়ূনের হিমু কি নিৎসের সুপারম্যান?

হিমু চরিত্র তার নিজ গুনবলে হয়ে উঠেছে নিৎসের সুপার ম্যান

 

নিৎসে তার Thus Spoke Zarathustra বইতে মানুষের চেয়েও উচ্চস্তরের মানুষের নাম দিয়েছেন Übermensch, ইংরেজিতে সুপারম্যান, বাংলায় মহাপুরুষ। কাকতালীয়? বোধয় না, কারণ সুপারম্যানের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যই মহাপুরুষ বা হিমুর সাথে মিলে যায়! 

 

যারা নিৎসের সুপারম্যান সম্পর্কে জানেন না, একটু প্রেক্ষাপট জানা যাক। Thus Spoke Zarathustra বইতে তে নিৎসে একটা ভবিষ্যৎ বানীর মত করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “God is dead, and we have killed him” এক কথায় সারমর্ম করলে, সভ্যতার এত উন্নয়নের কারণে মানুষ ঈশ্বরের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। অতঃপর ঈশ্বর প্রদত্ত নীতি, নিয়মের প্রতিও মানুষের অনাস্থা আসবে। যার কারণে মানুষ এক অপরিহার্য নিহিলিজম বা চূড়ান্ত উদাসীন্যে আক্রান্ত হবে। এখান থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় আছে, সেটা হলো মানুষের পরবর্তী বিবর্তন। 

 

বিবর্তন বলতে তিনি ডানা গজানো বা বড় মস্তিষ্কের কথা বলেন নি। তিনি মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের কথা বলেছেন। পরবর্তী বিবর্তনে মানুষ মানবিক ত্রুটি গুলো সরিয়ে আরো উচ্চ পর্যায়ের মানুষ বা সুপারম্যান হয়ে উঠবে। নিৎসের সুপারম্যান সম্পর্কে একদম স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। কিন্তু একটা কাঠামো তৈরি করে দিয়ে গেছেন। যেমন-

 

১। সুপারম্যান নিজের নীতি (value) তৈরি করবে, সমাজের প্রচলিত নীতির ধার ধারবে না।

২। সে চিন্তাভাবনায় মানবিক বায়াস থেকে মুক্ত থাকবে। এককথায় স্বাধীনমনা হবে।

৩। সুপারম্যান বৃহৎ স্বার্থে মানুষকে কষ্ট দিতে পারে, সে প্রয়োজনে পরিকল্পিত ভাবে স্বার্থপরতা দেখাতে পারে।

৪। সে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে মহান হবার পথে থাকবে।

৫। সে যৌনতার ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু লোভ ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত থাকবে।

৬। সে তার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত থাকবে, একই সাথে দুর্বলের প্রতি সদয় হবে। সুপারম্যানের অনেক বৈশিষ্ট্য হবে চমকে দেওয়ার মত এবং অস্বস্তিকর। 

 

(আসলে বিষদে না জানলে এগুলো ভুল অর্থ তৈরি করবে, তাই হালকাভাবে পড়ুন) যারা হিমুকে চেনেন, তাদের জন্য বোধ করি এটুকু ইশারাই যথেষ্ট। তবু আলোচনার স্বার্থে চলুন সংক্ষিপ্ত করে হিমুর সাদৃশ্য গুলো দেখা যাক।

 

হিমুর বাবা তার ছেলেকে মহাপুরুষ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যার জন্য হিমুকে নানা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নিৎসে বলেন, সুপারম্যান হওয়া খুবই কঠিন ও তপস্যার ব্যাপার। হিমু এখনে হেডস্টার্ট পেয়েছে পিতার সহযোগিতায়। হিমুর বাবা হিমুকে জগতের মায়া থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। মায়া মানুষের সবচেয়ে বড় বায়াস। যে কারণে হিমুর বাবা খুব সম্ভব হিমুর মা কে হত্যা করেন। শিশু হিমুর সামনে হিমুর বাচ্চা টিয়াপাখিকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন। এমন অনেক উদ্ভট কাণ্ডই হিমুর বাবা করেন।

 

হিমুর কোন নীতি বা value নাই। সে অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে। কথা দিয়ে নির্দ্বিধায় ভাঙতে পারে। “রুপা তুমি নীল শাড়ি পরে বারান্দায় দাঁড়াও থেকে– পরমুহুর্তেই— ভালোবাসার মানুষের খুব কাছে যেতে নেই” 

 

যাহোক। হিমুর খালি পা আর একটা হলুদ পাঞ্জাবী প্রথমেই ম্যাটেরিয়ালিস্টিক সমাজকে কাঁচকলা দেখায়। হিমু বিরাট স্বার্থপর। সে যাকে খুশি ম্যনিপুলেট করতে পারে, মহৎ কাজও অহরহই করে। হিমু যন্ত্রণাকে ভয় পায় না। তার জীবনের কোন গতি নেই। অর্থের সন্ধান নেই। থাকার ঠিকঠাক জায়গা নেই। তবু সে দিব্যি ঘোরে ফেরে। তাকে লোভ, মায়া, অনিরাপত্তা, অপমান কোনকিছুই স্পর্শ করে না। ঠিক যেমনটা নিৎসে বলেছেন। 

 

অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। বিস্তারিত একটা পেপার লেখার মত বিষয় এটা (কোনদিন লিখতে পারি) আর দুটো কথা বলে শেষ করি। এই দুটো কথা সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদের ভেতর নিৎসের প্রভাবটা স্পষ্ট করবে।

 

নিৎসের একটা প্রধান দর্শন হলো, ভালো মন্দের যে আদর্শ নীতি আছে সেটাকে প্রশ্ন করা। ওনার একটা বিখ্যাত বই, Beyond Good and Evil. হিমুর বাবার একটা কোট তুলে ধরি, হিমুর গলায় একবার কাঁটা বিঁধলো। হিমুর বাবা হিমুকে গলায় কাঁটা নিয়ে ঘুরতে দিলেন। কদিন পরে বললেন, মানুষের জীবনে খারাপ কাজ হলো কাঁটার মত, মানুষ খারাপ কাজ করলে তার অস্বস্তি হয়, অনুতাপ করে। সাধারণ মানুষের এটা দরকার আছে। মহাপুরুষদের দরকার নেই। এই কথার মাধ্যমে হিমুর বাবা প্রয়োজনে কোন অনুসূচনা ছাড়া মন্দ কাজ করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে বললেন! 

 

হিমুর মধ্য দুপুর বইতে হিমুর বাবা বলেন, “ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন, স্বপ্নের মূলে রয়েছে যৌনতা। এ কথা যে কতটা ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না” 

ফ্রয়েড আর নিৎসের দর্শন একে অন্যের বেশ বিরোধিতা করে। হুমায়ূন আহমেদ নিৎসের কথা কোথাও উল্লেখ না করলেও হিমুর বাবাকে দিয়ে ফ্রয়েডের সমালোচনা করিয়েছেন। এতে বেশি কিছু প্রমাণ না হলেও, সবকিছু মিলিয়ে আসলে বলাই যায়, হুমায়ূনের হিমু আসলে নিৎসের Übermensch থেকে তৈরি!

 

হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে সাহিত্য মান হ্যানত্যান অনেক কিছু নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু হিমু অগভীর বই যারা বলেন তাদের চিন্তার বিস্তৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। হিমু ফ্যানদের নিয়েও বেশ ট্রল দেখি ইদানীং। কিন্তু আদৌতে হিমু মনগড়া কাল্পনিক চরিত্র নয়, সত্যিকারের ফিলোসোফিক্যল মহাপুরুষ বলেই আমার ধারণা।


Kendrick Lamar

1 Blog posts

Comments